প্রিয় তরুণ প্রজন্ম

আরিফ জেবতিক


প্রথমেই তোমাদেরকে বুঝতে হবে যে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তোমরা, মানে তরুণ ভোটাররা অত্যন্ত বড় ফ্যাক্টর এখন। মানুষ একবার যে দলের প্রতি অনুগত হয়ে পড়ে, সেই আনুগত্য সহজে বদলায় না। বিশেষ করে কৈশোর-তারুণ্যের ভালোলাগাটুকু পরবর্তী জীবনেও কাটিয়ে ওঠা কষ্টের কাজ। তোমরা যারা ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে পড়াশোনা করো, তাঁরা নিশ্চয়ই ব্র্যান্ড লয়ালিটির বিষয়টি আরো ভালো বুঝবে। অন্যদের জন্য সহজ করে বলি, মানুষ শুরুতে যে ব্র্যান্ডের দুধ খায়, যে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজে, যে দৈনিক পত্রিকাটি প্রতিদিন পড়ে, সেটি সহজে বদলাতে চায় না। এটি অনেকটাই অভ্যাসের ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। রাজনীতিতে দলীয় আনুগত্যটাও এই ধরণের ব্র্যান্ড লয়ালিটির মধ্যেই পড়ে। তোমরা একটু খেয়াল করে দেখবে, তোমাদের বড় ভাই বা অভিবাভকরা যারা নৌকা মার্কায় ভোট দেন তাঁরা সাধারণত আওয়ামী লীগের সমালোচনা বেশি করতে পছন্দ করেন না, যারা ধানের শীষে ভোট দেন, তাঁরা চেষ্টা করেন বিএনপির দোষত্রুটিগুলোকে আড়ালে রাখতে। এবং প্রায় প্রতিবারই এরা প্রায় সবাই সেই একই মার্কায় ভোট দিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে তারা আগে ভোট দিয়েছিলেন।
তাহলে  চিন্তা করতে পারো যে, বেশিরভাগই যদি আগের মার্কায়ই ভোট দেয়, তাহলে প্রতিবার নির্বাচনের ফলাফল পাল্টাবে কীভাবে? এটাই আসল মজা। নির্বাচনে জিততে হলে নতুন ভোট লাগবে, আর সেই ভোটের বড় অংশের জোগানদার হচ্ছে প্রথমবার যারা ভোটার হয় তাঁরা। একবার যদি তাদের সমর্থন আদায় করা যায়, তাহলে নির্বাচনের ফলাফলে পার্থক্যটি তৈরি করা যায়। প্রতি ৫ বছর পরপর ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া এই প্রায় এককোটি নতুন ভোটারই তাই নির্বাচন জেতার আসল  চাবিকাঠি।
নিকট অতীতে আওয়ামী লীগ এটা বুঝতে পেরে গত নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে শক্ত করে তুলে ধরে, ঘরে ঘরে চাকুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আর ডিজিটাল বাংলাদেশের আকর্ষণীয় মোড়কে তাদের মার্কাকে বাজারজাত করে। ২০০৮ সালে তোমরা অনেকেই যারা জীবনের প্রথমবার ভোট দিয়েছ, তারা তাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বেছে নিয়েছ। এবারে বিএনপি বুঝতে  পেরেছে যে ২০০১ সালে তারা তরুণ ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার জন্য যে চেষ্টা করেছিল সেই একই চেষ্টা আগামী নির্বাচনে আরো জোরেশোরে করতে হবে, নইলে আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ কঠিন হবে। খালেদা জিয়া তাই সম্প্রতি ঘোষনা দিয়েছেন, তরুণ নেতাদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেবেন; মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাই তোমাদেরকে বিএনপির খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে আহ্বান জানাচ্ছেন।
তোমাদের বয়েস অল্প, দেশের জন্য কিছু করার জন্য তোমাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। তোমরা যতটুকু আবেগী, তার চাইতে অনেক কম দেখেছ জীবনের কুৎসিত রঙ পাল্টানো। সুতরাং তোমরা অনেকেই হয়তো ভাবছ, প্রচলিত দ্বিদলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে ঠিকই রাষ্ট্র ও সমাজ পাল্টে ফেলতে পারবে, নিজের দলকেও পাল্টাতে পারবে। তোমাদেরকে সেই আশ্বাস দেয়াও হচ্ছে। বিশ্বাস করো, বিষয়টি এত সহজ নয়।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যত বেশি দরকার তোমাদের ভোট, তোমাদের সক্রিয় মেধাবী অংশগ্রহন তাদের কাছে তেমন বেশি জরুরি নয়। তুমি রাজনীতিতে অংশ নাও না বলে তারা তোমাকে দোষারোপ করবেন কিন্তু তোমাকে অংশগ্রহন করতে দেওয়া হবে না কখনোই। কথাটা শুনে অবাক হলে? তাহলে আরেকটু খুলে বলি।
আচ্ছা, ধরো তুমি রাজনীতিতে জড়াতে চাও। দল হিসেবে দেশের বড় দুইটি দলের যেকোনো একটিতে তুমি যোগ দিতে চাও। কীভাবে দেবে? এদের দলের সদস্য হওয়ার পদ্ধতি কী? মাঝে মাঝে তোমরা টেলিভিশনে দেখো, এক দলে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করতে ব্যর্থ নেতা অন্য দলের নেত্রীর হাতে ফুল দিয়ে যোগদান করছে। এটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার কোনো সুস্থ পদ্ধতি নয়। পদ্ধতি হচ্ছে তুমি একটি দলের সদস্য ফরম পূরণ করে সেই দলে যোগ দিবে। সেই দলের গঠনতন্ত্র পড়বে, দলের কর্মসূচিগুলো ভালোভাবে আত্মস্থ করবে এবং দলের মাঝে তোমার অংশগ্রহন নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে দলের নেতা হয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে এমন কোনো চর্চা নেই। বিশ্বাস না হলে তোমার আশেপাশের যেকোনো আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করে দলের গঠনতন্ত্রের একটি কপি চেয়ে দেখতে পারো। কিংবা সদস্য হওয়ার জন্য একটি সদস্য ফরম চেয়ে দেখো। এদের কাছে কিছুই নেই। এরা অন্তসারশূন্য রাজনীতি করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দুয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে এদের বেশির ভাগেরই ধারণা বিরোধী দলে থাকলে হরতালে গাড়ি ভাঙ্গা এবং সরকারি দলে থাকলে থানায় গিয়ে তদবির করা আর টেন্ডারে ভাগ বসানোটাকেই রাজনীতি বলে। তুমি যদি আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কিংবা বিএনপির ১৯ দফা মুখস্ত বলতে পারবে তাদের নিজ দলের এমন কোনো স্থানীয় কর্মীর খোঁজ পাও, তাহলে আমাকে মিথ্যাবাদী বলতে পারো, আমি আপত্তি করব না।
কোনো ধরনের ফরম পূরণ ছাড়াই তুমি কোনো এক নেতার পাশে ঘুরঘুর করতে করতে নিজেকে ঐ দলের কর্মী বানিয়ে ফেলতে পারবে অবশ্য। তারপর? তুমি যদি টেন্ডারবাজি না করতে পারো, কিংবা থানায় গিয়ে দলের কর্মীকে তদবির করে ছুটিয়ে নিয়ে আসতে না পারো, তাহলে নেতা হিসেবে তোমার কোনো ভবিষ্যত নেই। আর যদি স্থানীয় এমপি সাহেবের সঙ্গে জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর করতে তোমার বিবেকে বাধে, তাহলে তো তুমি গন কেস। তোমার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ঝরঝরে, কারণ এমপি সাহেবই ওখানের দ-মু-ের কর্তা, তিনিই নিজের পছন্দ মতো ছোটখাটো কমিটিগুলো তৈরি করেন এবং নেতা বানান। তিনি নিজেও মনোনয়ন পান সেই জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর আর ট্যাকের জোরেই। তুমি কীভাবে তোমার দলকে বদলাবে যেখানে এসব অগনতান্ত্রিক এবং ব্যক্তিতোষণের রাজনীতির কুচক্রে তুমি নিজেই টিকে থাকতে পারবে না?
ঠিক আছে, তুমি না হয় ছাত্র রাজনীতি দিয়েই শুরু করতে চাও। আমি এখানে আমার ছোট্ট মফস্বল শহরের ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতাটুকু বলি। আমার ছাত্র রাজনীতির সময়কালীন সিলেটে ছাত্রদলের কোনো জেলা কাউন্সিল হয়নি। জানতে পারলাম শেষবারে সিলেটে ছাত্রদলের জেলা কাউন্সিল হয়েছে ২০০৩ সালে, আজ থেকে ৮ বছর আগে। যতদূর মনে পড়ে, গত ২১ বছরে এই মাত্র একবারই জেলা কাউন্সিল হয়েছে। ওখানে ছাত্রলীগের অবস্থাও প্রায় একই রকম খারাপ। আমার ছাত্রজীবনে তাদের কোনো জেলা কাউন্সিল হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সম্প্রতি তাদেরও একটি কমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, তবে সেটিও ঐ কেন্দ্র থেকে চাপানো কমিটিই, সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ে কমিটির পক্ষে বিপক্ষে খেয়োখেয়ি চলছেই।
সেই কবেকার তৈরি কমিটিগুলোর নেতারা এখন সবাই নিজেদের পেশা জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক, তাদের অনেকের ছেলে মেয়েই স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। তুমি তাদের সঙ্গে কীভাবে কমিউনিকেট করবে? তোমার সমস্যা তারা কতটুকু বুঝতে পারবেন আর বুঝতে পারলেও কতটুকু সময় তোমাকে দিতে পারবেন? নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়ায় এভাবেই প্রতিটি জেলা-উপজেলায় নেতাদের জট লেগে রয়েছে। ১০ বছরে সভাপতি হওয়ার মতো ১০ জন নেতা তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু যেহেতু সভাপতি বদলায় না, তাই অন্যরা নিজেদের মতো করে গ্রুপ উপগ্রুপ তৈরি করে আশায় আশায় থাকে, কোনো একদিন যদি নেতা হতে পারে। তারপর অবাক বিষ্ময়ে একদিন দেখে, এই ১০টা বছর মাঠে ময়দানে খেটেখুটে, ছোটভাইদেরকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে যে সমর্থন তারা অর্জন করেছে, তার বিন্দুমাত্র দাম কোথাও নেই। কারণ এসব জেলা কমিটি তৈরি হয় কেন্দ্র থেকে। তুমি শুনে থাকতে পারো, কেন্দ্র নামের এক অ™ভুত জায়গা থেকে রহস্যময় একটি ফ্যাক্সের মাধ্যমে প্রায়ই কমিটি তৈরি করা হয়, যার সঙ্গে মাঠের সমর্থনের যোগসূত্র থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। তোমরা কানাঘুষা শুনবে যে এত লাখ টাকার বিনিময়ে অমুক সভাপতি হয়েছে বা তমুক সাধারণ সম্পাদক হয়েছে তোমার স্থানীয় সংগঠনের। এই কথাগুলোর মধ্যে সত্যতা আছে কি না সেই তর্কে না গিয়েও তুমি বুঝতে পারবে, আসলে এই সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হয়ে নেতা হওয়াটা আজকাল অনেকটাই লটারির মতো, টাকা দিয়ে সে লটারি কিনে ভাগ্যে হয়তো শিকে ছিড়তে পারে, কিন্তু  মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বগুন কিংবা সমর্থনের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আর চল্লিশের চালশে লোকগুলো কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা কীভাবে হয়, সেটি তোমাকে এখন আর বলতে গেলাম না। এত গ্লানি তোমার জানার প্রয়োজন নেই এই বয়েসে।
সুতরাং যে তুমি একবুক আশা নিয়ে ভেবেছ, দলের জন্য জানপাত করলে একদিন নেতা হয়ে উঠবে এবং দল ও রাজনীতিকে সুন্দর করে তুলবে, তোমার জন্য তো এখানে কোনো দরজা খোলা নেই। ৫টি পচা আমের পাশে একটি ভালো আম রাখলে পচা আমগুলো ভালো হয় না, বরং ভালো আমটিই পচে যায়। তোমার অবস্থাও সে রকমই হতে পারে কিন্তু।
এই লেখাটি আর দীর্ঘ করতে চাই না, কারণ আমি জানি তোমরা আমার চাইতে অনেক বেশি জানো এবং বুঝো। আমি এখানে আমাদের অতীতমুখি রাজনীতির কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা বাতুলতা সেটা নিয়ে দীর্ঘ তর্ক করতে চাই না। ওটুকু তোমাদের সবাই ঠিকই বুঝতে পারো। যে যা-ই বলুক, তুমি জানো এরা কেউই আসলে গুড ম্যানেজার নয়, নিজেদের ভালোত্বের জন্য এরা ভোট জিতে না। এরা কে কার চাইতে কম খারাপ, এই বিবেচনায় মানুষ যখন যাকে কম খারাপ মনে করে, তখন তাকে ভোট দিয়ে বেশি খারাপকে ঠেকিয়ে রাখতে চায় মাত্র।
কিন্তু তোমাদের এই জানা এবং বোঝাটা আসলে অনেককেই চিন্তিত করবে। তারা তোমার মেধা কাজে লাগাতে চায় না, তারা চায় তোমার মাথাটা মিছিলে মাত্র একটি সংখ্যা বৃদ্ধি করুক। এজন্য তারা তোমাকে রাজনৈতিক দলের মধ্যে সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখাবে। একবার তুমি সেই স্বপ্নে মজেছ কি মরেছ। তারা তোমাকে ব্যবহার করবে, তোমার জীবন এলোমেলো করে দিবে, কিন্তু তুমি সেই স্বপ্নের সোনালি দিনে কখনোই পৌঁছাতে পারবে না।
আমি নিজেকে দিয়েই তোমাদের কাছে আবার উদাহরণ দেব। এরশাদ বিরোধী আন্দেলনে প্রতিটি দিন ছিল রক্তস্নাত, আমাদের ভাইয়েরা, বন্ধুরা মরছিল, আহত হচ্ছিল। ডিসেম্বরের দুই তারিখে সিলেটে বিডিআর নামানো হয়েছিল, সেই বিডিআরদের একজন আমার মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে গিয়েছিল, সেই আঘাত আমি হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে না পারলে হয়তো মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়ে সেদিনই মরে যেতাম। আজ এত বছর পরেও সেই হাতে কখনো সখনো ব্যথা করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমি ব্যালট হাতে নিয়ে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম। ঢাকায় আমার এলাকায় মহাজোটের প্রার্থী সেই স্বৈরাচারী এরশাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হলে আমাকে তবে এরশাদকে মেনে নিতে হবে। নূর হোসেনের জন্য আমি  কৈশোরে সারারাত কেঁদেছিলাম, সেই নূর হোসেনের ছবি বুকে নিয়ে আমার সেই আহত হাত দিয়ে কীভাবে এরশাদকে ভোট দেই? অন্যদিকে ৯১ সাল থেকে সিলেট শহরের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় জামায়াত শিবিরের আক্রমনে যেসব ছাত্রদল নেতাকর্মীর রক্ত ফিনকি দিয়ে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিল তাদের সেই রক্ত ভেজা আঙুলে আমি কীভাবে ৪ দলীয় জোটকে ভোট দিয়ে নিজামীকে মন্ত্রী বানাতে পারি? হায়, এই দলগুলোর সঙ্গেই আমি আর আমার বন্ধুরা বেড়ে উঠেছিলাম, আমরা আমাদের কৈশোর আর তারুণ্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে, পরীক্ষার আগের রাতেও মিছিলে স্লোগান তুলে, হুলিয়া মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে কৈশোর আর তারুণ্যের অপচয় করেছি। এরা কেউ আমাদের কথা মনে রাখে নি। এরা রাজনৈতিক বাস্তবতার ধূয়া তুলে আমাকে ভোটের বুথে ঠেলে দিয়েছে যেখানে আমার প্রতিপক্ষ এরশাদ আর গোলাম আযম আমারই ভোট পেয়ে ক্ষমতার মসনদে পৌঁছার জন্য হাসিমুখে অপেক্ষা করছিল। অথচ, আমার দুশ্চিন্তায় বাবার নিদ্রাহীন রাত্রি, মায়ের জায়নামাজে বসে থাকা, বোনের ছলছল চোখ, কবরে নামিয়ে দেওয়া আমার রাজপথের বন্ধুটির কথা আমাদের দলগুলো ভাবেনি। তারা আমার তারুণ্যের জীবনটাকে পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে একজন স্বৈরাচারের সঙ্গে আরেকজন রাজাকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। স্বার্থের প্রয়োজন পড়লে হয়তো আবার এরাই বন্ধু বদলে নিয়ে রাজাকারের বন্ধু স্বৈরাচারের বন্ধু হবে, স্বৈরাচারের বর্তমান বন্ধু রাজাকারের সঙ্গে গলাগলি করবে।
প্রিয় তরুণ, আমি তাই তোমাদেরকে বলি, এসব প্রথাগত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে দুইবার ভাবো। মিছিলে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করার রাজনীতি, ফ্যাক্সে নাম আসা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হওয়ার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে আরেকবার ভাবো। প্রতিটি মুহুর্তে ইতিহাসকে নিয়ে মিথ্যাচার করার আগে তোমার জ্বিহবার দুর্দশার কথাটি চিন্তা করো, চোর বাটপারদেরকে ‘ফুলের মতো পবিত্র’ বলে স্বাক্ষী দেওয়ার আগে নিজের বিবেকের উপর চোখ বুলিয়ে নিও।
তোমাদেরকে অনেকেই উপহাস করে বলবে তোমরা ডিজ্যুস প্রজন্ম, ইয়ো-ইয়ো প্রজন্ম; তোমাদের মাঝে রাষ্ট্র-দেশ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। বলবে দেশের কল্যাণে তোমরা নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চাও না, তোমরা দূর থেকে শুধু সমালোচনা করো. এগিয়ে এসে সমাধান করো না। আমি বলি, তোমরা এসব কথা শুনে বিন্দুমাত্র হতাশ হয়ো না।
আমি জানি তোমরা অনেক অনেক সচেতন। তোমরা জোর গলায় গাইতে পারো, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিরোধ করতে জানি।
তাই এত সহজেই প্রচলিত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ো না। তোমরা বরং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেও প্রতিনিয়ত রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠো। নিজেদের পথ নিজেরাই খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাও।

 তোমরা যখন দূরে দূরে থাকবে, তখন এসব রাজনৈতিক দল তোমাদেরকে নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাববে। তারা বুঝতে পারবে তোমাদেরকে রাজনীতিতে জড়াতে হলে রাস্তা সুগম আর সুস্থ করে দিতে হবে। তোমরা নেতা হতে চাও, নেতা বাছাইয়ের অধিকার চাও। তোমরা তোমাদের বিতর্ক করার শক্তি, আলোচনা করার বাগ্মীতা আর সংগঠন করার অসীম ক্ষমতার মূল্যায়ন চাও। তোমরা রাজনীতি নিয়ে পাঠচক্র চাও, তোমরা কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক চাও, তোমরা ইশতেহারগুলোকে নিখুঁতভাবে লিখে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতে চাও। তোমাদেরকে যখন মাথায় হাত বুলিয়েই  সহজে পাওয়া যাবে না, তখন রাজনৈতিক দলগুলো সেই ভালো পরিবেশ তৈরি করে দিতে বাধ্য হবে। তোমরা তাদের সঙ্গে মিশে বিলীন না হলেই বরং তারা তোমাদের মতো করে নিজেদেরকে সংস্কার করার কথা কোনো একদিন ভাবতে পারে। এই যে আওয়ামী লীগ ঢিমেতালে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, এর পেছনে আসল কারণ কিন্তু তারা জানে যে, তোমরা যারা তাদেরকে ভোট দিয়েছ, তারা কোনো ধরনের হাংকি পাংকি সহ্য করবে না। তারা তোমাদের এই মতামতকে সম্মান না জানালে তোমরা তাদেরকে ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না।
সুতরাং এখনই সরাসরি রাজনৈতিক দলের লেজে গাটছড়া না বেধে তুমি বরং তোমার মতো করেই কাজ করে যাও। কে বলেছে ফেসবুকে, ব্লগে লেখালেখি করলে রাজনীতি করা হয় না? কে বলেছে নিজেদের উদ্যোগে ছোট্ট একটা ব্যানার হাতে নিয়ে এক ঘন্টার মানববন্ধনে কোনো লাভ নেই? তুমি যখন ৩ মাসে সাড়ে ৪ লক্ষ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলে, তখন তো তুমি আওয়ামী লীগের কাছে গিয়ে কোনো সুবিধা দাবি করো নি। তোমাকে অবশ্যই বলবে জার্মানিতে নাৎসীদের নিয়ে অতীতচারি রাজনীতি হয় না, তুমিও ৭১ ভুলে যাও। এরা জানে না যে তুমি আজকাল গুগুলে খোঁজ নিয়ে জেনে গেছ, জার্মানিতে নাৎসীদের রাজনৈতিক দলই নিষিদ্ধ, বুড়ো ধামড়া কোনো যুদ্ধাপরাধীদেরকে পেলে সেখানে আজও বিচার হয়। এখানে যেদিন আমাদের বিচারও শেষ হবে, আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের দলও নিষিদ্ধ হবে, তুমিও তখন এসব নিয়ে আর উচ্চকণ্ঠ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখবে না। ইতিহাস তখনই শুধু বইয়ের পাতায় ঠাই নেবে, যেভাবে জার্মানিতে নিয়েছে। সুতরাং তোমাকে এসব ছেলে ভুলানো রাজনৈতি গপ্প দিলেই তুমি ভুলছ না। খালি গাড়ি ভাঙলেই কি রাজনীতি হয়, টেন্ডারবাজি করলেই কি নেতাগিরি হয়? সারা বিশ্ব এখন নতুন ধরনের রাজনীতিতে প্রবেশ করছে, তুমি সেই রাজনীতিটা শুরু করেছ আমাদের দেশে। সময় লাগবে বটে, তবে নতুন রাজনীতি আসবেই। কান পেতে একটু শুনে দেখো, সেই যাত্রাধ্বণি এখনই শোনা যাচ্ছে।
বুকে অসীম দেশপ্রেম রেখে, এই পোড়া দুঃখী দেশটির জন্য চোখে অনেক অশ্রু জমা রেখে তুমি তাই নিজেদের কাজটুকু করে যাও। তুমি রাজনৈতিক দলের পচা পুকুরে আরেক ফোটা জল হয়ে মিশে না গিয়ে বরং ক্রমাগত হাউস দ্যাট বলেই রাজনীতিকে বেশি শুদ্ধ করতে পারবে। অন্ধকার রাত যত গভীর হয়, ভোর আসার সময়টুকু ততোই কাছে এসে পড়ে। বিশ্বাস করো, অন্যের ঘুম পাড়ানি মিষ্টি কথায় কান দিয়ে নয়, বরং একা নিঃসঙ্গ জেগে থেকেই তুমি সেই সকালকে দ্রুত আনতে পারবে।
সেই আগামীর পথে তোমাকে আমার অভিবাদন প্রিয় তরুন, তোমাকে আমার স্যালুট

আরিফ জেবতিক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

No comments: